ক্লাসে বসে ঘড়ির দিকে অস্থির হয়ে বার বার তাকায় দীপা । আর মাত্র পনর মিনিট বাকী । তারপর ঢং ঢং করে ছুটির ঘণ্টা বাজবে । স্কুল টানা দুই সপ্তাহর জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। দুর্গা পূজার ছুটি । আজ দীপা বসেছে জানালার পাশের বেঞ্চে। আনমনে একবার বাইরে তাকায় সে। এখন মধ্যাহ্ন । সূর্য মাঝ আকাশে অবস্থান করলেও তাপের প্রখরতা তেমন নেই। শরৎকাল চলছে। এই বছর গ্রীষ্ম ঋতু ছিল প্রলম্বিত। বর্ষা এসেছে ধিরে। এখন এই শরতে মাঝে মাঝে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে দীপা একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল । অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ক্লাসে এসে হাজির হয় স্কুলের দপ্তরী। হাতে নোটিশের কাগজ। সুবল স্যার তখন বোর্ডে উৎপাদক করছেন। তার পেছনে ক্লাসে মৃদু গুঞ্জন চলছে। গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। নোটিশ দেখে সবাই উৎসুকভাবে সামনে তাকায়। কাগজ পড়ে সুবল স্যারের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। ক্লাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, সানজিদা সুলতানা আর শান্তা মারিয়া কে?
ভয়ে দীপার মুখ শুকিয়ে যায়। দীপার আসল নাম সানজিদা সুলতনা। পাশে শান্তা মারিয়া বসে আছে। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরা দুইজন দাড়াঁতেই স্যার বললেন, হেডমিস্ট্রেস তোমাদের ডেকেছেন। তিনি রুমে আছেন। তোমরা দুইজন দপ্তরীর সাথে যাও। করিডোর দিয়ে যেতে যেতে দীপা মনে করার চেষ্টা করে গত একমাসে সে কি কি অপকর্ম করেছে। দীপা আর শান্তা ক্লাসে অমনযোগী হিসেবে পরিচিত। ক্লাস চলাকালে প্রায় তারা গল্প করে। কামাল স্যার বলেন, এই দুটো হলো গল্পের জাহাজ। গত এক সপ্তাহ দীপা ইংরেজি ক্লাসে পড়া পারেনি। হঠাৎ তার মনে পরে, কয়েকদিন আগে স্কুলের অফিস রুমের পেছনে মাঠের পেয়ারা গাছ বেয়ে সে একতলার ছাদে ওঠার চেষ্টা করেছিল। তার এইসব কাজের সহযোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শী হলো শান্তা। দীপা শান্তার দিকে আড়চোখে তাকায়। ওর মুখও শুকিয়ে গেছে।
হেডমিস্ট্রেসের নাম শেফালি আক্তার। তার অফিস রুমটি অনাড়ম্বর ভাবে বিন্যস্থ। চেয়ার টেবিল ছাড়া ঘরে আছে দুটো বুক সেলফ। বুক সেলফ ভরা বই। এইসব বইয়ের সাথে দীপা অপরিচিত। শুধু ম্যাডামের টেবিলের একপাশে রাখা বইটি সে চিনতে পারে। রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা। শেফালি আক্তারের বয়স পয়তাল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে। সাদা পাড়বিহীন শাড়ি, এটে বাধা খোপা আর নিরাভরণ থাকা সত্ত্বেও এখনো তাকে সুশ্রী দেখায়। শেফালি আক্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন। দীপা লক্ষ্য করে ম্যাডামের মুখটা গম্ভীর।
তারা রুমে প্রবেশ করতেই হেডমিস্ট্রেস মেয়ে দুটোর দিকে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে শান্তা মারিয়া কে? শান্তা উত্তর দেয়, ম্যাডাম আমি। শেফালি আক্তার টেবিল থেকে একটা অঙ্ক বই তুলে নিয়ে বললেন, এটা নিশ্চয় তোমার বই। বইয়ের উপর তোমার নাম এবং রোল নম্বর লেখা। দুই দিন আগে ডেস্কে ছুটির সময় ফেলে রেখে গিয়েছ। অথচ কোনো খোজঁ করোনি। স্কুলের আয়া নিয়ে এসে আমার কাছে জমা দিয়ে গেছে। শান্তা একই ভাবে দাড়িঁয়ে থাকে। কিছু বলে না। তাদের নিশ্চুপ থাকতে দেখে ম্যাডাম একবার শান্তার দিকে আরেকবার দীপার দিকে তাকায়। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে আরেকটা বই বের করলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আর এই বইটা কার? বইয়ের মলাট দেখে দীপার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। মলাটের ছবিতে প্রায় উন্মুক্ত বক্ষের একটা মেয়ের ছবি। তাকে জড়িয়ে ধরে একটা ছেলে চুমু খাচ্ছে। বড়রা যাকে বলে অশ্লীল বই।
ম্যাডাম আগের মতো ঠান্ডা স্বরে বললেন, ট্রাশ লিটারেচার। এগুলো থেকে জানার কিছু নেই। তারপর চোখ তুলে বললেন, তোমরা কৈশোর কাল অতিক্রম করতে চলেছ। নারী এবং পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কৌতুহল হতে পারে। নারী এবং পুরুষের মধ্যে আকর্ষণ একটা স্বাভাবিক বিষয়। এই সম্পর্ক সম্বন্ধে বিকৃত পন্থা অনুসরন না করে সহজভাবে নিতে শিখবে। ইচ্ছা করলে তোমরা রবি ঠাকুরের উপন্যাস শেষের কবিতা অথবা হুমায়ুন আহমেদের কিছু বই পড়তে পার। আর প্রেমের শুভ পরিণতি তো বিয়ে। তারপর সংসারে হাড়ি ঠেলা। সেইসব কাজের জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। এখন একটু মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো।
ফেরার পথে শান্তা গজ গজ করছিল। কটকটি বুড়ি। শুধু উপদেশ দেয়। দীপা কিন্তু একমত হতে পারে না। সে বলে, আরে ছেড়ে দে। ম্যাডাম তো বড়দের মতো ধমক দেয় নাই। বাড়িতেও নালিশ পাঠায় নাই। ক্লাস ছুটির পর বাসায় ফিরে দীপা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তার বাবা মা উভয়ে চাকরিজীবী। তাদের বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে সে তিন তলার ব্যালকনিতে দাড়াঁয়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মন খারাপ করা একটা বিকাল। কেন যেন তার শেফালি আক্তারের কথা মনে হয়। কড়া প্রকৃতির শিক্ষক হিসেবে তিনি পরিচিত। অথচ তিনি কাউকে শাস্তি দেন না। আশ্চর্য রকমের কর্তব্যপরায়ণ এবং নিয়মনিষ্ঠ। ক্লাসে কেউ প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন না। সহজভাবে পড়া বুঝিয়ে দেন। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে দীপা সামনের চারতলা বাড়ির দিকে তাকায়। বাড়িটা শান্তাদের। ওরা দুই তলায় থাকে। বাকি সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া। দীপার চোখে পড়ে শান্তাদের বাড়ির নিচে রাস্তার ধারে একটা মোটর সাইকেল দাড়িঁয়ে আছে। আরোহী বিশ বাইশ বছরের একটা ছেলে। দীপা চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখে, ছেলেটার মাথায় হেলমেট নেই। মাথার চুলগুলো স্পাইক এবং অর্ধেক চুলে লাল রঙ করা। একটু পরে শান্তা বেরিয়ে আসে। তার পরণে জিনস এবং টপস। মোটর সাইকেলে ছেলেটার পিছনে বসে দুইজন ঘুরতে চলে যায়।
দুই দিন পর শান্তার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে দীপা। স্কুল ছুটির পর দুইজনের অবস্থাই রবি ঠাকুরের ভাষায়, কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, সেই গানের মতো। স্কুলের নিয়ম কানুন দুই জনের চোখে বিষবৎ। শান্তা তো স্কুলের নাম দিয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। বাটি থেকে একমুঠ চানাচুর মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে শান্তা বলে, আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম, বুঝলি। মিস হ্যাভিশাম কেস। দীপার মুখ ভর্তি পেপসি। সে ঢোক গিলে কিছু না বুঝে প্রশ্ন করে, কি কেস? শান্তা বলে, আরে আমাদের হেডমিস্ট্রেস শেফালি আক্তারের কথা বলছি। কাল চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস গ্রেট এক্সপেক্টেশন পড়ছিলাম। বইতে মিস হ্যাভিশাম নামের একজন ধনাঢ্য মহিলার কথা আছে। যৌবনে তার বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের দিন বর আসে নাই। তারপর মহিলা অস্বাভাবিক হয়ে যান। শেফালি আক্তারও একই কারণে বিয়ে করেন নাই। দীপা প্রশ্ন করে, তোকে এইসব কথা কে বলেছে? শান্তা বলে, রাতুল বলেছে। শেফালি আক্তারের ভাগ্নে। ম্যাডাম তার পরিবারের সাথে এক সঙ্গে বাস করেন। দীপা আবার বলে, রাতুল মানে ঐ চুলে রং করা , ছেড়া জিনস পড়া ছেলেটা? শান্তা চোখ সরু করে দীপার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না।
এবার কথাবার্তার প্রসঙ্গ রাতুলের দিকে মোড় নেয়। রাতুল শুধু হ্যান্ডসাম আর কৌতুকপ্রিয় নয়, তার মতো জিনিয়াস বাংলাদেশে নেই। সাত মসজিদ রোডের একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও ভর্তি হয় নাই। সারা বছর লেখাপড়া না করেও এক্সেলেন্ট রেজাল্ট করে। দীপা হা করে শান্তার কথা শুনছিল। শান্তা তখনো বলে চলেছে, জানিস, কয়েক দিন আগে রাতুলের সাথে বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখতে গিয়েছিলাম। বাহুবলী সিনেমার দৃশ্যায়ন দেখে তো আমি অবাক। দীপা শুনতে শুনতে হঠাৎ প্রশ্ন করে, আচ্ছা, সেদিনের সেই অশ্লীল বইটা কি রাতুল তোকে দিয়েছে? থতমত খেয়ে শান্তা দীপার দিকে তাকায়। কোনো কথা বলে না।
আরও তিনদিন কেটে গেছে। ছুটিগুলো এখন আর দীপার কাছে তেমন রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে না। এর চেয়ে স্কুল খোলা থাকলে কোনো একটা কাজের মধ্যে থাকা যায়। গত সপ্তাহয় বাবা দীপা কে আশাপূর্ণা দেবীর রচিত একটি বই কিনে দিয়েছেন। বইটির নাম প্রথম প্রতিশ্রুতি। বইটা পড়তে পড়তে দীপা ভাবে, লেখাপড়া শেখার জন্য, আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙ্গালি নারীদের কতো কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই সময় শান্তার ফোন আসে। দীপা মোবাইল কানে ধরতেই শান্তা বলে, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আয়। আর আসার সময় একটু সাজগোজ করে আসবি। শান্তার কণ্ঠে উত্তেজনার সুর। দীপা নিচে নেমে এসে শান্তাদের গেটের সামনে দাড়াঁয়। শান্তা আজ পড়েছে হলুদ শর্ট কামিজ, লাল সালোয়ার আর লাল ওড়না। ওকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। দীপা কে দেখতে পেয়ে সে বলে, রাতুল কে তোর কথা বলেছি। ও তোর সম্পর্কে বেশ কৌতুহলি। আমরা তিন জন আজ স্টার কাবাবে লাঞ্চ করবো। ঢোক গিলে দীপা বলে, মানে এক মোটর সাইকেলে তিনজন যাবো? আমি তো ঠিক মতো মোটর সাইকেলে চড়তেই পারি না।
তুই একটা অপদার্থ। শান্তা বিরক্ত হয়ে বলে। তারপর দীপা কে প্রায় জোর করে নিয়ে রাতুলদের বাড়ির দিকে হাটাঁ শুরু করে। রাতুলদের বাসা বেশ কাছে। শান্তাদের বাসা থেকে দুটো গলি পড়ে। লাল এবং সাদা রংয়ের তিন তলা বাড়িটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তবে গেটের সামনে কোনো দারোয়ান নাই। শান্তা বলে, চল ভিতরে যাই। রাতুল নিচে গাড়ির বারান্দায় অপেক্ষা করছে। দীপা বলে, আমার ভয় করছে।যদি হেডমিস্ট্রেসের সাথে দেখা হয়ে যায়? শান্তা এইবার রেগে যায়। সে বলে, দেখা হলে বলবি রাতুলের সাথে প্রেম করতে এসেছিস। তুই যে একটা আস্ত ভীতুর ডিম , সেটা জানতাম না। ছুটির দিনে ম্যাডাম তিন তলায় তার ঘরে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকেন। পৃথিবীতে তখন প্রলয়কান্ড ঘটে গেলেও তিনি টের পাবেন না। রীতিমত প্রেস্টিজ ইস্যু। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দীপা শান্তা কে অনুসরণ করে। গেট খুলে বেশি দূর যেতে হলো না। গাড়ির বারান্দায় রাতুল দাড়িঁয়ে আছে। তার পাশে শেফালি আক্তার। দুজনের মুখ গম্ভীর। তারা কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। শান্তা আর দীপা কে তারা দেখতে পায় নাই। তাদের দেখে শান্তা চট করে দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। হাত ধরে দীপা কে ও টেনে নেয়। লুকানো জায়গা থেকে তারা ম্যাডাম আর রাতুলের কথাবার্তা শুনতে পায়। ম্যাডাম গম্ভীর অথচ শান্ত কণ্ঠে বলছিলেন, এইচ এস সি পরীক্ষার পর তুমি কোথাও ভর্তি হতে পার নাই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তে চেয়েছো। আমি টাকা দিয়েছি। এখন এক সেমিস্টারে দুইবার ফেল করেছো। আমি এই টাকা দিতে পারব না।
চীৎকার করে রাতুল বলে, টাকা চাইছি, টাকা দিবি। এতো ঝামেলা করিস কেন? শেফালি আক্তার আগের মতো শান্ত অথচ কঠিন স্বরে বললেন, ফেনসিডিল খেয়ে নেশা করতে চাইলে অন্যত্র করো। আমার সামনে নয়। তুমি যদি নিজে কে সংশোধন না করো তবে আমি তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে বাধ্য হবো। হিস হিস করে ওঠে রাতুল, টাকা কিভাবে আদায় করতে হয় আমার জানা আছে। শেফালি আক্তার আর কোনো কথা না বলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে যান। তার অপসৃয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে রাতুল বলে, আইবুড়ি, ডাইনি। টাকা দেবে না। টাকা নিয়ে কবরে যাবে। ক্রদ্ধ রাতুল সেখানে কিছুক্ষণ দাড়িঁয়ে থাকে। তারপর গেট খুলে উদ্ধত ভঙ্গীতে চলে যায়। দীপা ও শান্তা নিঃশব্দে লুকানো জায়গা থেকে বেড়িয়ে বাড়ির দিকে চলে যায়। এই ঘটনার পর শান্তা আর রাতুলের সাথে যোগাযোগ করে নাই।
সেদিন রাতে দীপার ঘুম আসছিল না। বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে দাড়াঁয়। আজ আকাশ মেঘ মুক্ত। তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীপা স্বৃতির ধুসর পথ কল্পনা করে। সে যেন তারই মতো একজন কিশোরী কে দেখতে পায়। এক মাথা কোকঁড়া চুল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুশ্রী মেয়েটি নাম শেফালি। সারাক্ষণ হাসিখুশি। মায়ের আদর ভরা বকুনি উপেক্ষা করে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। এইবার শরৎকালে তাদের পাড়ায় মিত্রদের বাড়িতে দূর্গা পূজা হবে। শেফালি মা কে বলে কয়ে রাজী করিয়েছে। মেজ চাচার সাথে বিকালে পূজা দেখতে যাবে। খুব ভোরে উঠে পরে শেফালি। শিউলি ফুল কুড়াবার জন্য। একটু রোদ উঠলে ফুলগুলো মলিন হয়ে যায়। ভোরে বাবা বারান্দায় বসে কোরআন শরীফ পড়েন। পা টিপে টিপে বেরিয়ে যায় শেফালি। গাছের তলায় শিউলি ফুল কুড়াতে কুড়াতে তার হুশ ছিল না। হঠাৎ মনে হলো, কে যেন তাকে দেখছে। চকিতে পেছনে তাকায় শেফালি। কেউ নেই। আবার ফুল কুড়াতে গিয়ে দেখে তার সামনে রাস্তার অপর পাশে একটি ছেলে তাকে দেখছে। সে বয়সে শেফালির থেকে তিন চার বছরের বড় হবে। তরুণের দুই চোখে মুগ্ধতা। শেফালি কয়েক মূহুর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ফুল ফেলে উঠে এক ছুটে পালিয়ে যায়। দিন গড়িয়ে যেতে থাকে। তরুণ তরুণী দুইজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ, কথাবার্তা, প্রণয় সবই হয়। তাদের পরিবারের মধ্যে কথাবার্তায় স্থির হলো বিয়ের তারিখ।
অবশেষে সেই দিনটি আসে। কনের বাড়ি আজ ঝলমলে আলোক সজ্জ্বায় সেজেছে। মেয়ের বাবা ব্যস্ত হয়ে সব কাজ তদারক করছেন। শেফালির মনে হলো, তার বাবা যেন খুব ক্লান্ত এবং বিষন্ন। কিন্তু বাইরের কোলাহলে তার সব ভাবনা চাপা পরে যায়। শেফালি আজ পড়েছে লাল বেনারশি। ঘরে বসেই সে শুনতে পায় বর এসে গেছে। বর যাত্রী বসেছে পাশের ঘরে। বিয়ে পর্ব শেষ হলে অতিথিদের আপ্যায়ন শুরু হবে। পাশের ঘরের প্রতিটি শব্দ শেফালি অধীর আগ্রহে শুনছে। একসময় তার মনে হয়, কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। সবাই একসাথে কথা বলা শুরু করেছে। আর সবাই কে ছাপিয়ে ছেলের বাবা উচ্চ কণ্ঠে বলছেন, আপনি কি ভেবেছেন? আপনার মেয়ের মুখ দেখে এই বিয়ের সম্বন্ধ করা হয়েছে।? কথাবার্তা বলার সময় তো আমরা আমাদের দাবী জানিয়ে দিয়েছি। নগদ দশ লাখ টাকা বিয়েতে দিতে হবে। এখন আপনি চার লাখ টাকা আমার হাতে দিয়ে মেয়ে বিদায় করতে চাইছেন? আপনি কি ফকিরের ভিক্ষা দিচ্ছেন? শেফালির বাবা করুণ স্বরে অনুনয় করে বলেন, বিশ্বাস করেন খোন্দকার সাহেব, আগামী বছর আমি অবসরে যাব। তখন পেনশনের টাকা থেকে আপনার সব পাওনা পরিশোধ করে দেবো। শোরগোল ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে ছেলের বাবা পাত্র কে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের আসর থেকে বের হয়ে চলে যায়। এইসব ঘটনা পাত্রের সম্মুখে ঘটেছিল। কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করেনি। নির্বিকার ভাবে ছেলেটি সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। ডেকোরেটরের দোকান থেকে ভাড়া করে আনা টেবিলে পোলাও মাংস স্তুপাকারে পড়ে আছে। কেউ স্পর্শ করে নাই। আত্নীয় স্বজন , প্রতিবেশীরা ইতোমধ্যে ফিরে চলে গেছে। যাবার আগে বেশ জোর গলায় শুনিয়ে বলেছে, অপয়া মেয়েমানুষ। নিশ্চয় ভিতরে কোনো গোপন ব্যাপার আছে। বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন বাবা। পুরো বাড়ি কবরের মতো নিস্তব্ধ। শুধু থেকে থেকে মায়ের কান্না শোনা যাচ্ছে। অপয়া, অলক্ষ্ণী, গলায় দড়ি দিয়ে মর তুই। এই ঘটনা শেফালির উপর কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা জানা যায় না। তবে এইটুকু নিশ্চিত সে আত্নহত্যা করে নাই। সপ্তাহ তিনেক পরে কলতলায় শেফালি কে পানি নিতে আসতে দেখে প্রতিবেশীরা চমকে যায়। সাদা থান পরিহিত বিধবার বেশে শেফালি কে দেখে মনে হয় বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। সে নিবিষ্ট মনে টিউবয়লের হ্যান্ডেল চাপছে। সমাজ কর্তৃক প্রত্যাখাত হবার পরেও সে পরাজয় স্বীকার করে নাই। বিরতির পর শেফালি আবার কলেজে যাওয়া শুরু করে। মাস্টার্স পাস করার পর তাকে দ্বিতীয় আঘাতটি সহ্য করতে হয়। স্ট্রোকে বাবার মৃত্যু হয়। সমগ্র পরিবারের দায় এসে পড়ে শেফালির কাধেঁ। সে এই দায়িত্ত্ব অস্বীকার করেনি। স্কুলে চাকরি করে সংসারের খরচ দিয়েছে। চার ভাই বোনের লেখাপড়ার করার খরচ বহন করেছে। শেফালি আক্তারের ভাই বোন রা আজ সবাই প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেকের নিজের সংসার জীবন আছে। সেখানে তিনি অপাঙ্গক্তেয়। পরিবারের কাছে শেফালি আক্তার ভারবাহী জীব ছাড়া আর কিছু নয়। টাকা যোগান দিতে না পারলে তিনি মূল্যহীন।
রাত ভোর হয়ে এসেছে। সূর্যের কিরণ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। শরতের সকাল। দীপা তখনো বারান্দায় দাড়িঁয়ে আছে। সে ভাবছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা বেগম রোকেয়ার মতো মনীষীরা আলো হাতে আধাঁরের পথ চলার নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই যাত্রা আজও শেষ হয় নাই। মুক্তির পথ শুধু বন্ধুরই নয়, দীর্ঘও হয় বটে।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
স্কুল টানা দুই সপ্তাহর জন্য বন্ধ হয়ে যাবে শরতের শেফালি
০৩ মার্চ - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
৩৬ টি
সমন্বিত স্কোর
৩.৯
বিচারক স্কোরঃ ২.১ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪